শুভ জন্মদিন ধোনি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  নয়ন মোঙ্গিয়া অবসরে যাওয়ার পর আর ভালো কোনো উইকেটরক্ষক পাচ্ছিল না ভারত। পার্থিব প্যাটেল, দীনেশ কার্তিকরা টেস্টে মোটামুটি করলেও ওয়ানডেতে একজন স্পেশালিস্ট উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের খোঁজে ছিল দেশটি। ভারতীয় ক্রিকেটের দুঃসময়ে দেখা দেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। ধীরে ধীরে বিশাল বড় এক বটবৃক্ষ হয়ে ভাতীয় ক্রিকেটকে অনেকদিন ধরে সেবা দিয়ে চলেছেন তিনি। আজ ৩৬ বছরে পা দিলেন এই ক্রিকেটার। শুভ জন্মদিন মাহি।

বলা হয়ে থাকে, সঠিক সময় সঠিক জায়গায় থেকে সঠিক কাজ করাকেই ভাগ্য বলে আর বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারাই নেতার অন্যতম বড় গুণ। সেই অর্থে ধোনিকে নেতা ও ভাগ্যবান স্বীকার করে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয় কারো। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখার অসামান্য দক্ষতার কারণেই অধিনায়ক হিসেবে সবার কাছেই দৃষ্টান্ত মহেন্দ্র সিং ধোনি।

কেবল অধিনায়ক নন, ক্রিকেটে সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি রান এটাও প্রমাণ করে দেশটির সেরা ব্যাটসম্যাদের একজন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে দলের প্রয়োজন মুহূর্তে উইকেটে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে কার্যকরী ব্যাটসম্যান বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বে নেই। তাঁকে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক বলা হয়। দেখে নেওয়া যাক, সাধারণ এক যুবক মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে অসাধারণ নেতা ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হয়ে ওঠার পেছনের কয়েকটি গল্প :

২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা তো কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওয়ানডে ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে প্রথম থেকেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটবিরোধী ছিল ভারত। আর এই কারণেই প্রথম বিশ্বকাপে দল পাঠাতে চায়নি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রিকেট বোর্ড। তবে বাকি দেশগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত দল পাঠাতে বাধ্য হয় ভারত। নিয়মিত অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় বা সিনিয়র শেবাগ, যুবরাজ নয়, তরুণ মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে তেরাঙ্গা তুলে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় দল পাঠায় দেশটি। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের প্রথম ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায়। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামে ভারত। ব্যাট হাতে ৩৩ রান করে ভারতকে ১৪১ রানের মোটামুটি সংগ্রহ এনে দেন ধোনি। জবাবে পাকিস্তানও করে ১৪১ রান। ইতিহাসের প্রথম ও শেষ বল আউটে ৩-০ ব্যবধানে পাকিস্তানকে হারায় ভারত। বল আউটে পাকিস্তান যেখানে উমর গুল ও ইয়াসির আরাফাতের মতো পেসারদের দিয়ে বল করায় চালাক ধোনি সেখানে শেবাগ, রবিন উথাপ্পা ও হরভজন সিংয়ের মতো স্পিনার দিয়ে স্টাম্পে লাগার প্রতিযোগিতায় নামে। পাকিস্তানি বোলাররা একটি বলও স্টাম্পে লাগাতে পারেননি, সেখানে শেবাগ-হরভজনরা প্রতিটি বলই স্টাম্পে লাগান।

বহুল আলোচিত সেই প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালের কথাটা তো কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। মিসবাহ উল হক-ঝড়ে ম্যাচ যখন ভারতের হাত থেকে পুরোপুরি ফস্কে গেছে, সেই মুহূর্তেও দারুণ নির্লিপ্ত মহেন্দ্র সিং ধোনি। শেষ ওভারে যোগিন্দর শর্মার হাতে বল তুলে নিয়ে একটা জুয়ার চাল দেন তিনি। আর শ্রীশান্তের হাতে মিসবাহকে আউট করে ভারতকে বিশ্বকাপ জেতান যোগিন্দর। তবে নেপথ্য নায়ক তো ধোনিই!

অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অজিদের হারানো আর এভারেস্টে ওঠা প্রায় একই কথা। তবে দুরূহ সেই কাজটি অনায়াসেই করেছিলেন ধোনি। তিন ম্যাচের ফাইনালে প্রথম দুটিতেই জয় পায় ভারত। দ্বিতীয় ফাইনালে ধোনির অধিনায়ত্ব ছিল দেখার মতো। প্রবীণ কুমারের সুইংয়ে অস্ট্রেলিয়া শুরুতেই তিন উইকেট হারালেও ম্যাথু হেইডেন ও অ্যান্ডু সায়মন্ডসের জুটিতে খেলায় ফেরে অজিরা। জুটিটা যখনই বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল, ধোনি নিয়ে এলেন তাঁর বিশ্বস্ত অস্ত্র হরভজন সিংকে। হেইডেন রান আউট আর সায়মন্ডসকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন ভাজ্জি। ইনিংসের শেষ দিকে জেমস হোপস যখন অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনো মাথা ঠান্ডা রাখেন ধোনি আর ৯ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ নিয়ে ঘরে ফেরে ভারত।

ধোনি সত্যিকার অর্থে ক্যাপ্টেন কুল হয়ে ওঠেন ২০১১ সালের বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ধোনির বেশ ভালো ধৈর্যের পরীক্ষা হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি দেন ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২৭৫ রান তাড়া করতে গিয়ে ১১৪ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে তখন চিন্তার মুখে ভারত। এই সময় যুবরাজকে বসিয়ে দিয়ে চতুর্থ স্থানে ব্যাটিং করতে আসেন ধোনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিলেন সবাই। কারণ এর আগের ম্যাচগুলোতে রান পাননি তিনি। আর ৭৯ বলে অপরাজিত ৯১ রান করে ভারতকে বিশ্বকাপটা জেতান তো ধোনিই। গম্ভীরের সঙ্গে ১০৯ আর যুবরাজের সঙ্গে ৫৪ রান যোগ করে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন তিনি।

দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করা ভারত তরতর করে উঠে যায় ফাইনালে। বৃষ্টির কারণে ফাইনাল ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসে ২০ ওভারে। ইংলিশ পেসারদের দাপটে ১২৯ রানে শেষ হয় ভারতের ইনিংস। ইংলিশ কন্ডিশনে এই রানটাকেই স্বাগতিকদের জন্য কঠিন করে তোলেন অশ্বিন-জাদেজারা। মরগান ও বোপারার জুটিতে ম্যাচে ফেরে স্বাগতিকরা। এই জুটিতে ইংল্যান্ড ম্যাচটা পকেটে পুরেই ফেলেছিল। ধোনির কপালে কয়েকটা চিন্তার রেখা। কারণ জয় থেকে মাত্র ১৯ রান দূরে মরগানের দল। সেই সময়ে একটা জুয়া খেলে বসেন ধোনি। বল তুলে দেন ইশান্ত শর্মার হাতে। অন্য কেউ হলে ইশান্তের বিষয়ে দুবার ভাবতেন, তবে ধোনি ইশান্তকেই নিয়ে এলেন। আগের তিন ওভারে ব্যয়বহুল ও ছন্নছাড়া ইশান্ত তাঁর শেষ ওভারে প্রথমে মরগান ও পরের বলে বোপারাকে ফিরিয়ে দিয়ে ম্যাচটাকে ভারতের দিকে নিয়ে চলে আসেন। পরে অশ্বিন কেবল নিজের সম্মান রেখে ম্যাচের আনুষ্ঠানিকতাটুকু শেষ করেন। দলের ওপর ভরসা রেখে আরেকবার জিতে গেলেন ধোনি।

২০১৬ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে ধোনির ব্যাটের ক্ষত আজও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে রয়েছে। বৃষ্টিস্নাত মিরপুরের পিচ থেকে রান নেওয়াটা সহজ হচ্ছিল না। বাংলাদেশের করা ১২০ রানের জবাবে ৯৯ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারায় ভারত। আবার রায়না-যুবরাজদের আগে ব্যাট হাতে নেমে পড়েন ধোনি। অধিনায়ক যখন উইকেটে আসেন, জয় থেকে তখনো ২২ রান দূরে তাঁর দল। হাতে রয়েছে ২ ওভার। আল আমিনের ওভারে চার বলে ১৭ রান নিয়ে ম্যাচটাকে শেষ ওভারে গড়াতেই দেননি ধোনি। নিজের ওপরে বিশ্বাস রেখে আরেকবার সফল ক্যাপ্টেন কুল।

গত বছর ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নেন এই ক্রিকেটার। এর আগে এভাবেই ২০১৪ সালে হুট করে টেস্ট থেকে অবসর নেন ভারতের এই সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। ওয়ানডেতে ১৯৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে তেরঙ্গাধারীদের ১১০ ম্যাচে জেতান ধোনি। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর অধিনায়কত্বে ৭২টি ম্যাচের ৪১টিতে জয় পায় ভারত। আর এই জন্যই তাঁকে ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মনে করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর